“বিপদে আমায় রক্ষা করো এনহে মোর প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিপদে যেন না করি ভয়”
যখনই কোনো আতঙ্ক ছড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিছু শ্রেনী সেখানে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে এবং এখনও সেটা চলছে। নিজেদের স্বার্থে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এটাকে একটা ভয়ঙ্কর বিষয়ে পরিনত করেছে তারা। করোনা নিয়ে সচতনতার চেয়ে এখন আতঙ্কই বেশি। কিন্তু এই আতঙ্ক কতোটা যৌক্তিক –
১। নতুন কিছু নয়, নতুন ধরন মাত্র
আমরা জানি যে, করোনা নতুন কোনো ভাইরাস/রোগ নয়। পুরোনো ফ্লু’র নতুন এক ধরনের ভ্যারিয়েশন মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই নতুন ভাইরাসের সাথে ফাইট করার মত শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম তরুন বা শিশুদের যেমন থাকে, প্রবীণ বা দীর্ঘমেয়াদী রোগ আছে এমন মানুষদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক দুর্বল থাকে। যে কারনে, সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে আছেন তারা। ২০১৮-১৯ এ আমেরিকাতে ফ্লুতে মৃত্যু বরণ করা ৩৪,২০০ জনের মধ্যে ৭৫% হচ্ছেন প্রবীন [১]।
২। বাস্তবতা
সিজনাল ফ্লুতে (শীতকালীন হালকা জ্বর, সর্দি, কাশি) সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর শুধু ফুসফুস জনিত ইনফেকশনেই প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ লোক মারা যান [২,৩,৪]। আর বছরে আক্রান্ত হন প্রায় ১ বিলিয়নেরও বেশী [৩,৪]। অন্যদিকে করোনা তে গত তিন মাসে আক্রান্ত প্রায় ৭ লক্ষ, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩২ হাজার [৫]।
“লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার,
শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার।”
যেই রোগের ৭০-৯০ শতাংশের জন্য হাসপাতালে যাওয়ারও প্রয়োজন হয় না [৬,৭], তা নিয়ে আতংকিত হওয়ার চেয়ে প্রয়োজন সচেতন থেকে নিজ নিজ সরকার আর স্বাস্থ্য বিভাগের সহজ নির্দেশনাগুলো অনুসরন…
৩। ইউরোপ/আমেরিকার দুরাবস্থা কেন?
ইরানের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় গোরামী বা ধর্মান্ধতা আর সরকারের উদাসীনতা একটা বড় কারন। আর ইতালীর ক্ষেত্রে – পৃথিবীতে যে কয়টি দেশে বয়স্ক মানুষের হার সবচেয়ে বেশী তাতে দ্বিতীয় ইতালী (২৩%) [৮]। ইউরোপিয়ান অধিকাংশ দেশেরই একই অবস্থা। বয়সভিত্তিক মৃত্যুহারের দিকেও ফ্লুতে মৃত্যু কিন্তু ইউরোপেই সবচেয়ে বেশি (৮৪%), আর দ্বিতীয় স্থানে পুরো আমেরিকা মহাদেশদ্বয়(৭৫%) [২]। অতএব, সচেতন না হলে ইউরোপ, আমেরিকা যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পরবে সেটা অনুমেয়।
৪। আমাদের উপমহাদেশ
ভারতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৯৮৭আর মৃত্যু মাত্র ২৫! ভারতের ডেমোগ্রাফি যেহেতু অনেকটাই বাংলাদেশের মত, তাই তুলনাটা সহজ। দুটি দেশই জনবহুল। কিন্তু এরপরেও করোনার হানা ইউরোপের মত না হওয়ার একটা বড় কারন এই অঞ্চলের মানুষের বয়স (তরুনদের সংখ্যা) এবং তাদের ইমিউন সিস্টেম। সে সাথে আবহাওয়াও গুরুত্বপূর্নভূমিকা পালন করছে [৯]। সবমিলে এ অঞ্চলের মানুষের ফ্লুতে মৃত্যু অন্য অঞ্চলের চেয়ে সবসময়ই কম। ধরে নিলাম, অফিসিয়ালি যা বলা হচ্ছে আসল রূপ তার ৩ গুন। তা হলেও মৃত্যু সংখ্যা ১০০’র নিচে, যা ঘনবসতিপূর্ন বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশের (১৩৮ কোটি) জন্য কম।
৫। আতঙ্কের কিছু নেই
অতএব, করোনা নিয়ে আতংকিত হবার চেয়ে প্রয়োজন সচাতনতার। সরকার তাদের দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে (কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়), কিন্তু আমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে সেটা ম্যানেজ করা আরও দুঃসাধ্য হয়ে পরবে।
খুব খারাপ লাগে যখন দেখি হাসপাতাল নির্মানে বাঁধা দেয়া হচ্ছে, বয়স্ক শ্রমজীবীদের খাবার দেয়ার পরিবর্তে তাদের কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে, তরুন/যুবক ডাক্তার/নার্সরা পেশেন্টের কাছে যাচ্ছেনই না, ভয়ে… আতঙ্কে; ভাইরাস আক্রান্ত ব্যাক্তির কবর/সৎকারের বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলন করছে, কিংবা অসুস্থ একজন আশেপাশের কাউকে পাশে পাচ্ছে না। জবাবদিহিতার দিনে আল্লাহ যেদিন প্রশ্ন করবেন – “আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার খোঁজ রাখো নি। আমি ক্ষুধায় কাতর ছিলাম, আমাকে খাবার দাও নি।” তখন কি উত্তর দিব আমরা?
৬। সেবা আর প্রার্থনার মাধ্যমে করুনাময়ের রহমতের ছায়ায় থাকুন
আমাদের আচরন আরেকজন মানুষকে যেমন ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে, তেমনি আমাদের আচরণই পারে এই সঙ্কট থেকে তাদের মুক্ত করতে। প্রবীন যারা আছেন তাদের সেবা-যত্ন নিশ্চিত করার দায়িত্বটা তরুণদেরই। তারা বসায় থাকতে থাকতে যেন বোরডোমে না ভোগেন সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশে অনেক শ্রমজীবী আছেন যারা বয়স্ক। তারা যেন ঠিকভাবে সেবা পায়। আর নর্থ আমেরিকায় যেহেতু এই গ্রুপ বেশি তাই এখানেও সচেতন হওয়া জরুরী।
৭। শেষ কথা
ভালো লাগে যখন দেখি কিছু মানুষ পারিপার্শ্বিক বাঁধার দিকে না তাকিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন; পয়সা দিয়ে, খাবার দিয়ে, শ্রম দিয়ে অন্যদের সেবা করে যাচ্ছেন। আবার অনেক ডাক্তার আছেন, সারা পৃথিবীতে রিসোর্স সল্পতার বাস্তবতাটা মেনে নিয়ে একটু ঝুকি নিয়েই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মৃত্যু হলেও এই ডাক্তারের চেয়ে সৌভাগ্যবান কয়জন হতে পারবেন?
খেয়াল রাখতে হবে “সামাজিক দূরত্ব” তৈরির মাধ্যমে আমরা যেন মানুষ হিসেবে আমাদের পরস্পর প্রতি মানবিকতা, দায়িত্ব, মমতা হারিয়ে না ফেলি।
সূত্রসমূহ
- https://www.cdc.gov/flu/about/burden/2018-2019.html
- https://dx.doi.org/10.7189%2Fjogh.09.020421
- https://apps.who.int/iris/handle/10665/311184
- https://doi.org/10.1016/S0140-6736(17)33293-2
- https://coronavirus.jhu.edu/map.html
- https://www.cdc.gov/mmwr/volumes/69/wr/mm6912e2.htm
- https://nationalpost.com/news/world/covid-19-in-canada-six-per-cent-of-cases-need-hospital-care-one-per-cent-are-fatal
- https://data.worldbank.org/indicator/SP.POP.65UP.TO.ZS?name_desc=false&view=chart
- https://doi.org/10.1155/2011/734690
- কভার ছবিঃ https://www.kare11.com